ইফতার ও সাহরিতে কী খাবেন

আমাদের দেশে রমজান মাস এলেই খাওয়া-দাওয়ার ধুম পড়ে যায়। মানুষ অস্থির হয়ে পড়ে কী খাবে, কী খাবে না এসব নিয়ে। রোজায় প্রতিদিনের খাবারের মেন্যুতে আসে ভিন্নতা, তার সঙ্গে সময়ের ব্যবধান তো রয়েছেই। আপাতদৃষ্টিতে আমাদের অনেকেরই মনে হতে পারে, রোজায় ১৪-১৫ ঘণ্টা না খেয়ে থেকে স্বাস্থ্যহানি ঘটতে পারে। তাই ইফতারে বেশি বেশি খাওয়া ভালো। রোজায় খাবারের বিরতি কম হওয়ায় প্রয়োজনের তুলনায় বেশি খাওয়া হয়ে যায়। আবার অনেকেই বলেন, রোজায় খাবারের হিসাব নেই। তাই রোজায় রকমারি খাবারের আয়োজন বেড়ে যায়, যা কিনা স্বাস্থ্য উপযোগী নয়। তবে দৈনিক চাহিদার প্রতি লক্ষ্য রেখেই খাদ্য নির্বাচন করা দরকার। রোজা পালনের জন্য প্রয়োজন সঠিক ডায়েট নির্বাচন, শারীরিক সুস্থতা, মানসিক শক্তি এবং অদম্য ইচ্ছা ও আনুগত্য। আর চিকিৎসক ও পুষ্টিবিদদের মতে, কিছু নিয়মনীতি ও পরামর্শ অনুসরণ করলে কষ্ট ছাড়াই রোজা পালন করা যায়।

কী খাবেন ইফতার

রমজান মাস এলে বিকেল থেকেই ইফতারের জন্য নানা খাবার তৈরি ও বিক্রির হিড়িক পড়ে। হরেক রকম ইফতারির পসরা সাজিয়ে দোকানিরা রাস্তার ধারে, ফুটপাতে, অলিগলিতে, হাটবাজারে সাজিয়ে রাখেন। এসব ইফতারির মধ্যে রয়েছে ছোলা, মুড়ি, পেঁয়াজু, বেগুনি, ডালবড়া, সবজিবড়া, আলুর চপ, খোলা খেজুর, হালিম, জালি কাবাব, জিলাপি, বুন্দিয়া ইত্যাদি। আরও রয়েছে বিভিন্ন ফল ও ফলের রস, আখের গুড়ের শরবত, নানা রং মিশ্রিত বাহারি শরবত। তা ছাড়া মুখরোচক বিরিয়ানি ও তেহারি তো আছেই।

 

প্রশ্ন হলো, এসব মুখরোচক খাবার স্বাস্থ্যসম্মত উপায়ে তৈরি করা হয়েছে কিনা। বেসনে ও উপাদানে কৃত্রিম রং মেশানো হয়েছে কিনা, সেদিকে নজর দেওয়া উচিত। যে তেলে ভাজা হয়, সেই তেল একবারের বেশি ব্যবহার করা উচিত নয়। কারণ, ব্যবহৃত তেল পুনরায় আগুনে ফোটানো হলে কয়েক ধরনের রাসায়নিক দ্রব্য তৈরি হয়, যেমন- পলি নিউক্লিয়ার হাইড্রোকার্বন, যার মধ্যে বেনজা পাইরিন নামে ক্যান্সার সৃষ্টি করতে পারে এমন পদার্থের মাত্রা বেশি থাকে। তা ছাড়া অপরিষ্কারভাবে ইফতারি তৈরি করলে পেটের পীড়া হওয়ার আশঙ্কা থাকে। সুস্থভাবে বাঁচার জন্য যত্রতত্র খোলা খাবার না খাওয়াই উচিত। খুব কম ফলই পাওয়া যাবে যা ভেজালমুক্ত। শরবতের কথা তো বলাই বাহুল্য। রাস্তাঘাটে, হাটবাজারে রকমারি শরবত তৈরি করা হয়। আমাদের জানতে হবে, এসব শরবত যে পানি দিয়ে বানানো হয়, সে পানি বিশুদ্ধ কিনা। তা ছাড়া ইফতারের জন্য তৈরি প্রায় সব খাবার সঠিক নিয়মে ভাজা হয় না। তাই এসব স্বাস্থ্যসম্মত নয়। একজন রোজাদার ইফতারে কী খাবেন তা নির্ভর করবে তাঁর স্বাস্থ্যের অবস্থা ও বয়সের ওপর। পারতপক্ষে দোকানের তৈরি ইফতার ও সাহরিসামগ্রী না খাওয়া বা এড়িয়ে চলাই ভালো। সুস্থ, স্বাস্থ্যবান রোজাদারের জন্য ইফতারে খেজুর বা খোরমা, ঘরের তৈরি বিশুদ্ধ শরবত, কচি শসা, পিঁয়াজু, বুট, মৌসুমি ফল থাকা ভালো। ফলমূল খেলে ভিটামিন ও মিনারেল পাওয়া যায়, কোষ্ঠকাঠিন্য দূর হয় এবং সহজে তা হজম হয়। রুচি অনুযায়ী বাসার রান্না করা নুডলসও খেতে পারেন। বেশি ভাজা-ভুনা, তেহারি, হালিম না খাওয়াই ভালো। কারণ এতে বদহজম হতে পারে। রুচি পরিবর্তনের জন্য দু-একটি জিলাপি খেতে পারেন। তা ছাড়া গ্রীষ্মকালীন রমজানে পরিমাণমতো বিশুদ্ধ পানি পান করা উচিত। এশা ও তারাবির নামাজের পর অভ্যাস অনুযায়ী পরিমাণমতো ভাত, মাছ অথবা মুরগির মাংস, ডাল ও সবজি খাবেন।

কী খাবেন সাহরিতে

রমজানে স্বাভাবিক নিয়ম পরিবর্তন করে সুবহে সাদিকের আগে ঘুম থেকে উঠে খাওয়া-দাওয়া সেরে নিতে হয়। সকালের নাশতার পরিবর্তে খুব ভোরে সারাদিনের উপবাসের সময় চলার মতো খাবারের প্রয়োজন হয়। শরীরটাকে সুস্থ রাখার জন্য সাহরি খাওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মনে রাখতে হবে, সাহরির খাবার মুখরোচক, সহজপাচ্য ও স্বাস্থ্যসম্মত হওয়া প্রয়োজন। অধিক তেল, অধিক ঝাল, অধিক চর্বিজাতীয় খাবার খাওয়া একদম উচিত নয়।

ভাতের সঙ্গে মিশ্র সবজি, মাছ অথবা মাংস খাবেন। অনেকেই মনে করেন, যেহেতু সারাদিন না খেয়ে থাকতে হবে, তাই সাহরির সময় প্রয়োজনের অতিরিক্ত বেশি বেশি খাবার খেতে হবে, তা মোটেই ঠিক নয়। কারণ, চার-পাঁচ ঘণ্টা পার হলেই খাদ্যগুলো পাকস্থলী থেকে অন্ত্রে গিয়ে হজম হয়ে যায়। তাই প্রয়োজনের তুলনায় বেশি না খাওয়াই ভালো, বরং মাত্রাতিরিক্ত খেলে ক্ষতির শঙ্কাই বেশি।

পিপাসা নিবারণ হয়, সেই পরিমাণ পানি নিজের অভ্যাস অনুযায়ী পান করতে হবে। দীর্ঘ সময় অভুক্ত থাকার কারণে শরীরে পানিশূন্যতা দেখা দিতে পারে এবং পানিশূন্যতার কারণে শরীরে নানা জটিলতা দেখা দেয়। তাই ইফতার থেকে সাহরি পর্যন্ত পর্যায়ক্রমে অন্তত দেড় থেকে দুই লিটার পানি পান করবেন। অনেকে পানির পরিবর্তে লেমন অথবা রোজ ওয়াটার, ফ্রুট ওয়াটার, নানা ধরনের শরবত, ভিটামিন ওয়াটারসহ নানা ধরনের প্রক্রিয়াজাত পানীয় পান করেন। এগুলো পরিহার করা ভালো। রোজাদারদের শুধু বিশুদ্ধ পানি পান করাই ভালো। প্রচুর সবুজ শাকসবজি, ফলমূল আহার করা উচিত।

উপসংহার

রমজান মাসে রোজা রাখার মাধ্যমে একজন ব্যক্তি সহজেই তাঁর স্বাস্থ্যের উল্লেখযোগ্য উন্নতি ঘটাতে পারেন, যদি ঠিক ডায়েট অনুসরণ করা হয়। কিছু টিপস মনে রাখুন:

(১) অতিভোজন থেকেও বিরত থাকুন। খাবার ভালোভাবে চিবিয়ে ধীরে ধীরে খান, যা আপনার হজমে সহায়ক হবে।
(২) কখনোই শুধু পানি খেয়ে রোজা রাখবেন না। সাহরি খাওয়ার সুন্নত, অনেকেই সেহরিতে কিছুই খান না, তা ঠিক নয়।
(৩) ইফতার ও সেহরির সময়ের মধ্যে অন্তত আট গ্লাস পানি পান করুন। গ্লাস গুনে পানি খেতে অসুবিধা হলে সমপরিমাণ পানি বোতলে ভরে রাখুন এবং ইফতার থেকে সাহরির সময়ের মধ্যে তার পুরোটা পান করুন।
(৪) ইফতারে বেশি ক্যালরি সমৃদ্ধ এবং সহজে ও তাড়াতাড়ি হজম হয়, এমন খাদ্য গ্রহণ করুন। সাহরিতেও সহজপাচ্য খাবার খান।
(৫) ভাজাপোড়া ও অতিরিক্ত মসলাযুক্ত খাদ্য বুক জ্বালাপোড়া এবং বদ হজমের সমস্যা তৈরি করে, তাই এগুলো বর্জন করুন।
(৬) রান্নার সময় ডালডার পরিবর্তে সয়াবিন তেল ব্যবহার করুন।
(৭) অতিরিক্ত লবণ ও লবনাক্ত খাবার গ্রহণ থেকে বিরত থাকুন, কারণ এসব রোজার সময় পানির পিপাসা বৃদ্ধি করে।
(৮) যাদের চা, কফির আসক্তি আছে, তারা এগুলো কমিয়ে আনার চেষ্টা করুন।
(৯) ঘুমানোর আগে ও সাহরির পরে অবশ্যই দাঁত ব্রাশ করতে ভুলবেন না।
(১০) রোজা রাখা অবস্থায় সকালে ব্যায়াম না করে ইফতারের পর ব্যায়াম করা উচিত।

মনে রাখবেন, অতিরিক্ত খাবার গ্রহণের কারণেই অসুস্থতা দেখা দিয়ে থাকে। ১১ মাস পর এ সময়ে রোজাদারদের খাদ্যাভ্যাস এবং জীবনযাত্রায় হঠাৎ বেশ পরিবর্তন আসে। তাই যারা নিয়মিত রোজা রাখেন, তাদের খাদ্য গ্রহণ ও স্বাস্থ্যের প্রতি খেয়াল রাখতে হবে। ইফতার ও সাহরির খাবার নিয়ে যত্নবান হতে হবে।

লেখক: ইমেরিটাস অধ্যাপক ও প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক।