দেশের উচ্চশিক্ষার পীঠস্থান বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রী নিপীড়ন থামছেই না। অনেক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রী নির্যাতন, নিপীড়নে কলুষিত হচ্ছে। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ছাত্রী ফাইরুজ অবন্তিকা নিপীড়নের শিকার হয়ে শুক্রবার আত্মহত্যা করেছেন। এ ছাড়া সম্প্রতি ঢাকা, জাহাঙ্গীরনগর, চট্টগ্রাম, ইসলামী, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামসহ বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রীদের ওপর যৌন নিপীড়নের ঘটনা ঘটেছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে জড়িতদের বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে সাময়িক বহিষ্কার ছাড়া কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি। বড় অপরাধে ছোট মাত্রার শাস্তি হওয়ার কারণেই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো দিনে দিনে ছাত্রী নিপীড়নে কলুষিত হয়ে উঠছে। ছাত্রী নিপীড়নে জড়িতরা প্রভাবশালী হওয়ায় অনেক ক্ষেত্রে অভিযোগও করতে সাহস পান না ভুক্তভোগীরা। দু-একটি ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে লিখিত অভিযোগ দিলেও অভিযোগ রয়েছে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ন্যায়বিচার না পাওয়ার। বিচার না পেয়ে দিনের পর দিন ট্রমার শিকার হন ছাত্রীরা। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এটি গড়ায় আত্মহত্যা পর্যন্ত। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ গতকাল প্রতিবেদককে বলেন, ‘শুধু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় নয়, দেশের স্কুল-কলেজ-মাদরাসা সবখানেই ছাত্রী নিপীড়ন-নির্যাতনের ঘটনা বাড়ছে। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় ছাত্রী নিপীড়ন-নির্যাতনে বরাবরই ছাত্রলীগের জড়িত থাকার অভিযোগ আছে। আর ছাত্রলীগকে এখন পৃষ্ঠপোষকতা করছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। তাই তাদের অপরাধের বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বিচার হয় না।’
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সূত্র প্রতিবেদককে জানান, ছাত্রী আত্মহত্যার ঘটনায় অভিযুক্ত সহকারী অধ্যাপক দ্বীন ইসলাম অতীতে ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত থাকায় সহকারী প্রক্টর হিসেবেও বেপরোয়া হয়ে উঠেছিলেন। ছাত্রী আত্মহত্যার পর অভিযুক্ত দ্বীন ইসলামকে বাঁচাতে এখন ছাত্রলীগের একটি পক্ষ উঠেপড়ে লেগেছে। অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, ‘জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে নিপীড়নের শিকার হওয়া মেয়েটি তো অভিযোগ করেছিল। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ভুক্তভোগীরা তো অভিযোগ করতেও সাহস পান না। আর নিপীড়করা কর্তৃপক্ষের পৃষ্ঠপোষকতা পাওয়ার কারণে তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থাই নেওয়া হয় না। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যৌন নিপীড়ন-হয়রানি বন্ধ করতে হলে তাদের পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়া বন্ধ করতে হবে।’ এই শিক্ষাবিদ আরও বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন চাইলেই এগুলো বন্ধ করতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন মেরুদণ্ডহীন হলে ক্যাম্পাসে এমন অপরাধ বৃদ্ধি পায়। আর বর্তমানে সরকার এমন ব্যক্তিদের উপাচার্য নিয়োগ করছে যারা এসব নিপীড়ন-হয়রানি বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে চান না।’ তথ্যমতে, ২০০৯ সালে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জন্য যৌন নিপীড়নবিরোধী নীতিমালা নিয়ে রায় দেন হাই কোর্ট। এতে বলা হয় : শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ সব সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানির বিরুদ্ধে অভিযোগ গ্রহণ, তদন্ত পরিচালনা ও সুপারিশ করার জন্য একটি অভিযোগ কমিটি গঠন করতে হবে। ওই রায়ের পর বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে যৌন নিপীড়নবিরোধী সেল গঠন করা হয়। কিন্তু নিপীড়নে জড়িত ব্যক্তি প্রভাবশালী বা ছাত্রনেতা হওয়ায় অনেক ক্ষেত্রে অভিযোগ করতেও ভয় পান। খুব নগণ্যসংখ্যক অভিযোগ করলেও ন্যায্য বিচার পান না। সব মিলেই বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসগুলো নিপীড়কের অভয়ারণ্যে পরিণত হতে চলেছে। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) চেয়ারম্যান (অতিরিক্ত দায়িত্ব) অধ্যাপক মুহাম্মদ আলমগীর গতকাল বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় তো সমাজেরই অংশ। শুধু বিশ্ববিদ্যালয় নয়, পুরো সমাজেই রয়েছে ছাত্রী নিপীড়ন-নির্যাতনের চিত্র। কিন্তু এর সমাধান তো আত্মহত্যা হতে পারে না। এমন প্রতিকূল পরিস্থিতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ গড়ে তুলতে হবে। আমাদের দেশে যে কোনো অপরাধ, ঘটনার বিচার হতে দীর্ঘ সময় চলে যায়। এ সময়ের মধ্যে অনেক কিছু ঘটে যায়। ছাত্রী নিপীড়নের অভিযোগ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে কালবিলম্ব না করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। প্রশাসনের উদাসীনতায় ছাত্রী নিপীড়নের মতো ঘটনা ঘটে যাচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে নিপীড়ন-নির্যাতন কোনোভাবেই বরদাশত করা যাবে না।’