৮ বছর পর সচল হচ্ছে সিলেটের সব পাথর কোয়ারি

 

‘আত্মঘাতী’ সিদ্ধান্ত বলছেন পরিবেশকর্মীরা

ডেস্ক রিপোর্টঃঃ

প্রায় ৮ বছর বন্ধ থাকার পর অবশেষে সচল হতে যাচ্ছে সিলেটের আট পাথর কোয়ারি। পরিবেশ কর্মীদের আপত্তি উপেক্ষা করেই সিলেটের পাথর কোয়ারিগুলোর ইজারা বন্ধের সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসেছে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়।

মন্ত্রণালয়ের এমন সিদ্ধান্তকে ‘আত্মঘাতী’ হিসেবে অভিহিত করেছেন পরিবেশকর্মীরা।

যদিও, সিলেটের পাথর কোয়ারিগুলো খুলে দেওয়ার জন্য দীর্ঘদিন ধরে দাবি জানিয়ে আসছেন এখানকার ব্যবসায়ী ও শ্রমিকরা। এই দাবিতে দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলনও করছেন তারা।

মন্ত্রণালয়ের নতুন সিদ্ধান্তের ফলে পাথর ব্যবসায়ীদেরই জয় হলো। ফলে দীর্ঘ ৮ বছর পর খুলতে যাচ্ছে কোয়ারিগুলো। তবে প্রাণ, প্রকৃতি ও পরিবেশের স্বার্থে কোয়ারি থেকে পাথর উত্তোলন বন্ধের দাবি পরিবেশ কর্মীদের।

গত সোমবার (১৩ই জানুয়ারি) বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব সাবরিনা আফরিন মোস্তফা স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, “সারা দেশের গেজেটভুক্ত পাথর কোয়ারি, সিলিকাবালু কোয়ারি, নূরী পাথর, সাদা মাটি উত্তোলনসহ অন্যান্য সকল কোয়ারির ইজারা আপাতত বন্ধ থাকার নির্দেশ বাতিল করা হলো।”

এতে করে সিলেটসহ সারাদেশ বন্ধ থাকা সকল পাথর ও বালু মহাল থেকে পাথর, বালু, সাদামাটি উত্তোলনে আর বাধা থাকলো না।

জানা যায়, সিলেটের কোয়ারিগুলো থেকে পাথর উত্তোলনে ব্যবহার করা হতো বিশাল একেকটি যন্ত্রের। বোমা মেশিন নামে পরিচিত এসব যন্ত্র মাটির অনেক গভীর থেকে পাথর তুলে আনতো। ফলে যেসব এলাকায় এসব মেশিন দিয়ে পাথর তোলা হয় সেসব স্থানে তৈরি হয় বড় বড় গর্ত। ভাঙন দেখা দেয় কোয়ারি তীরবর্তী এলাকায়। এতে বিপন্ন হয়ে পড়ে এলাকার পরিবেশ।

বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) হিসেব মতে, বেপরোয়া পাথর উত্তোলনে সিলেটে ২০০৫ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ১০৬ জন শ্রমিক নিহত হয়েছেন এবং আহত হয়েছেন ৩৫ জন। এরমধ্যে কোম্পানীগঞ্জের শাহ আরেফিন টিলা থেকে পাথর তুলতে গিয়েই মাটিচাপায় মারা গেছেন অর্ধশতাধিক শ্রমিক।

প্রাণ, পরিবেশ ও পর্যটন শিল্প রক্ষায় অপরিকল্পিতভাবে পাথর উত্তোলন বন্ধের দাবি জানানো হচ্ছিলো দীর্ঘদিন থেকেই। এমন দাবি জানিয়ে উচ্চ আদালতে একটি রিট আবেদন করে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা)। তাদের রিটের প্রেক্ষিতে ২০১৪ সালে সিলেটের পাথর কোয়ারিগুলোতে যন্ত্রের ব্যবহার নিষিদ্ধ করে উচ্চ আদালত।

এ অবস্থায় ২০১৬ সালের ১ সেপ্টেম্বর প্রাণহানি ও পরিবেশের বিপর্যয় ঠেকাতে সিলেটের জাফলং, ভোলাগঞ্জ, শাহ আরেফিন টিলা, বিছনাকান্দি ও লোভছড়া- এই পাঁচ কোয়ারি থেকে পাথর উত্তোলন নিষিদ্ধ করে খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়। আর ২০১৮সালে খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় থেকে সরকারিভাবে তালিকাভুক্ত সিলেটের ৮টি পাথর কোয়ারির ইজারা স্থগিত করে এবং পাথর উত্তোলন বন্ধ করা হয়।

তারও আগে ২০১২ সালে জাফলংয়ের পিয়াইন নদীসহ ১৫ কিলোমিটার পরিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা (ইসিএ) হিসেবে ঘোষণা করা হয়।

এ-সংক্রান্ত গেজেটে বলা হয়, ‘অপরিকল্পিতভাবে যেখানে সেখানে পাথর উত্তোলন ও নানাবিধ কার্যকলাপের ফলে সিলেটের জাফলং-ডাউকি নদীর প্রতিবেশ ব্যবস্থা সংকটাপন্ন। ইসিএভুক্ত এলাকায় যান্ত্রিক বা ম্যানুয়াল কিংবা অন্য কোনো পদ্ধতিতে পাথরসহ অন্য যেকোনো খনিজ সম্পদ উত্তোলন নিষিদ্ধ।’

তবে পাথর ব্যবসায়ীরা বারবারই দাবি জানাচ্ছিলেন, কয়েক বছর কোয়ারি বন্ধ থাকা ও পাথর উত্তোলন না করায় নদীর প্রবেশমুখে স্তূপাকারে আটকে আছে পাথর। এতে পানির স্বাভাবিক প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হয়ে নদীর গতিপথ পরিবর্তিত হচ্ছে।

অন্যদিকে, পাথর উত্তোলন বন্ধ থাকলেও ৫ আগস্ট পটপরিবর্তনের পর পাথরের ব্যাপক লুটপাট শুরু হয়। আগস্টের পর থেকে এ পর্যন্ত সিলেটের কোয়ারিগুলো থেকে হাজার কোটি টাকার পাথর লুটের অভিযোগ রয়েছে। প্রশাসনের নিয়মিত অভিযান সত্ত্বেও লুটপাট বন্ধ হচ্ছে না। এতে পাথর উত্তোলন অব্যাহত থাকলেও রাজস্ব হারাচ্ছিল সরকার। এ অবস্থায় কোয়ারিগুলো ইজারা প্রদানের সিদ্ধান্ত নেয় মন্ত্রণালয়।

জাফলং স্টোন ক্রাশার মিল মালিক সমিতির সভাপতি বাবলু বখত বলেন, “পাথর উত্তোলন বন্ধ থাকায় প্রতিবছরই ভারত থেকে প্রচুর পরিমাণ পাথর আমদানি করতে হচ্ছে। এতে দেশে ডলার সংকট আরও বাড়ছে।”

তার দাবি, স্থানীয় অর্থনীতির মজবুত ভিত্তি হচ্ছে পাথর কোয়ারি। কোয়ারিগুলো থেকে ম্যানুয়েল পদ্ধতিতে পাথর উত্তোলন করলে পরিবেশের কোনো ক্ষতি হবে না।

তবে মন্ত্রণালয়ের এই সিদ্ধান্তকে আত্মঘাতী হিসেবে অভিহিত করেছেন বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) সিলেটের সমন্বয়কারী শাহ শাহেদা আক্তার।

তিনি বলেন, পাথর কোয়ারিগুলোর ব্যাপারে মন্ত্রণালয় যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে তা আত্মঘাতী। কোয়ারি চালু হলে পরিবেশ, প্রকৃতি, জনস্বার্থ, সর্বপোরি জীবনের জন্য  হুমকি হয়ে দাঁড়াবে। আগামীতে আমাদের সবাইকে এর বড় মাসুল দিতে হবে।

সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বেলা’র প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা থাকাকালে পাথর উত্তোলন বন্ধে সবসময় সোচ্ছার ছিলেন, বর্তমানে তিনি পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টার দায়িত্বে রয়েছেন, তারপরও কেন পাথর কোয়ারি ইজারা প্রদানের সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো- এমন প্রশ্নের জবাবে শাহ শাহেদা আক্তার বলেন, “সরকারের দায়িত্ব নেয়ার পর রিজওয়ানা আপা আর বেলার সাথে সম্পৃক্ত নন। ফলে সরকারের সিদ্ধান্তের ব্যাপারে আমি কিছু বলতে পারবো না। তবে বেলা নিজের অবস্থান থেকে এ ব্যাপারে লড়াই অব্যাহত রাখবে।”

এ ব্যাপারে সিলেটের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শের মাহবুব মুরাদ বলেন, মন্ত্রণালয়ের কোন নির্দেশনা এখন পর্যন্ত আসেনি। আসার পর এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।