দেশের স্কুল-কলেজের শাখা ক্যাম্পাস চালুর সুযোগ বন্ধ হচ্ছে। শুধু তাই নয়, ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ, মতিঝিলের আইডিয়াল স্কুল বা মনিপুর উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ের মতো যেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ইতিমধ্যে একাধিক শাখা ক্যাম্পাস চালু রয়েছে, সেসব শাখাও হবে একেকটি স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান। স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা কমিটি ও প্রতিষ্ঠানপ্রধানও হবেন আলাদা।
বর্তমানে একই পরিচালনা কমিটির অধীনে চলে শাখা ক্যাম্পাস। প্রতিটি শাখার জন্য একজন করে শাখাপ্রধান থাকলেও প্রতিষ্ঠানপ্রধান একজনই।
নতুন উদ্যোগ বাস্তবায়নের জন্য বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের (স্কুল ও কলেজ) জনবলকাঠামো ও এমপিও নীতিমালা সংশোধন করা হচ্ছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উচ্চপর্যায়ের একটি সূত্র প্রথম আলোকে এই তথ্য জানিয়েছে।
এ বিষয়ে শিক্ষা বোর্ডগুলোর চেয়ারম্যানদের সমন্বয় কমিটির প্রধান ও ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক তপন কুমার সরকার প্রথম আলোকে বলেন, ‘এ বিষয়ে মোটামুটি সিদ্ধান্ত হয়ে গেছে। খুব শিগগির আদেশ জারি হওয়ার কথা রয়েছে।’
বিদ্যমান বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের (স্কুল ও কলেজ) জনবলকাঠামো ও এমপিও নীতিমালায় বলা হয়েছে, কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তার অনুমোদিত মূল ক্যাম্পাস ছাড়া অন্য কোথাও শাখা খুলতে পারবে না। তবে বাস্তবতা বিবেচনায় চাহিদা, উপযুক্ততা এবং প্রতিষ্ঠানের নামে খতিয়ানভুক্ত ও নামজারি করা নিজস্ব জমি থাকলে ওই জমিতে কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নতুন শাখা খোলার বিষয়টি মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ বিবেচনা করতে পারবে।
নতুন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে বিদ্যমান নীতিমালাটির এই অংশটি সংশোধন বা বাদ হতে পারে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র জানিয়েছে, তাদের পর্যবেক্ষণ হলো ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ, মতিঝিলে অবস্থিত আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজ এবং মনিপুর উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ের মতো কতগুলো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বিভিন্ন সময়ে একাধিক শাখা ক্যাম্পাস গড়ে তুলেছে। কিন্তু একই পরিচালনা কমিটি এবং একই প্রতিষ্ঠানপ্রধানের মাধ্যমে এসব প্রতিষ্ঠানের সব শাখা ক্যাম্পাস ভালোভাবে চলছে না। বরং নানা ধরনের অভিযোগ উঠছে। মূলত এমন বাস্তবতার বিষয়টি বিবেচনা করে শাখা ক্যাম্পাসকে স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
প্রসঙ্গত, একসময় দেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিজেদের মতো শাখা ক্যাম্পাস করে একধরনের বাণিজ্যে লিপ্ত হয়েছিল। পরে সরকার শাখা ক্যাম্পাসের সুযোগ বন্ধ করেছিল।
শাখা ক্যাম্পাসের উদাহরণ
রাজধানীর বেইলি রোডে ১৯৫২ সালে ভিকারুননিসা নূন স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়। বর্তমানে ভিকারুননিসার বেইলি রোডের মূল ক্যাম্পাস ছাড়াও বসুন্ধরা, আজিমপুর ও ধানমন্ডি শাখায় শিক্ষা কার্যক্রম চলছে। সব মিলিয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির মোট ছাত্রীর সংখ্যা প্রায় ২৫ হাজার।
দুই দশক ধরে অনেকটাই ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের ওপর ভর করে চলছে নামকরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি। বর্তমান ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ নিয়োগের বিষয়টি আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছিল। বিভিন্ন সময়ে ভর্তিতে অনিয়ম, আর্থিক অনিয়ম ছাড়াও নানা ধরনের অভিযোগ উঠছে এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে। সম্প্রতি ছাত্রীদের যৌন হয়রানি করার অভিযোগে এই প্রতিষ্ঠানের একটি শাখা ক্যাম্পাসের একজন জ্যেষ্ঠ শিক্ষককে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়েছে। গত বছর আরেকটি শাখা ক্যাম্পাসের একজন
শিক্ষকের বিরুদ্ধেও ওই প্রতিষ্ঠানের এক ছাত্রীকে যৌন হয়রানি করার অভিযোগ উঠেছিল।
অভিযোগ আছে, মূল ক্যাম্পাসের পাশাপাশি পৃথক শাখা ক্যাম্পাসে বিপুলসংখ্যক ছাত্রীকে একই প্রতিষ্ঠানপ্রধান ও পরিচালনা কমিটির অধীনে দেখভাল করা দুরূহ বিষয় হয়ে গেছে।
কমবেশি একই অবস্থা চলছে রাজধানীর মতিঝিলের আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজে। মতিঝিল এজিবি কলোনির বাসিন্দাদের উদ্যোগে ১৯৬৫ সালে মতিঝিলে ‘আইডিয়াল স্কুল’ নামে প্রথমে প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। পরে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক স্তর চালু করা হয়। এখন মতিঝিলের মূল ক্যাম্পাস ছাড়াও রাজধানীর বনশ্রী ও মুগদায় শাখা ক্যাম্পাসে বিদ্যালয়টির শিক্ষা কার্যক্রম চলছে। এর মধ্যে অবশ্য মুগদার শাখা ক্যাম্পাস সরকারের যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমোদন ছাড়াই চালু করায় প্রথমে বেশ জটিলতার সৃষ্টি হয়েছিল। যদিও পরে সরকারের উচ্চপর্যায়ের হস্তক্ষেপে বিষয়টির সমাধান হয়। সব কটি শাখা মিলে এখন মোট শিক্ষার্থী প্রায় ২৮ হাজার। শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারী আছেন ৭০০-এর বেশি।
একসময় বিদ্যালয়টি ঘিরে ‘ভর্তি-বাণিজ্য’ ছিল সবচেয়ে আলোচিত বিষয়। কিন্তু ২০২১ সাল থেকে সরকারি ব্যবস্থাপনায় লটারির মাধ্যমে শিক্ষার্থী ভর্তি শুরুর পর এই অভিযোগের ব্যাপকতা কমে গেছে। তবে একেবারে শেষ হয়ে যায়নি। এ ছাড়া শিক্ষকদের ‘প্রাইভেট-কোচিং বাণিজ্য’ অনেকটা স্বাভাবিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। সম্প্রতি পরিচালনা কমিটির এক সদস্যের ‘অনৈতিক কাজ’ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করেছে।
১৯৬৯ সালে প্রতিষ্ঠিত রাজধানীর মিরপুর এলাকায় অবস্থিত মনিপুর উচ্চবিদ্যালয়ে অভিযোগের শেষ নেই। বিদ্যালয়টি নিয়ে সম্প্রতি জাতীয় সংসদে পর্যন্ত আলোচনা হয়েছে। মূল ক্যাম্পাসসহ চারটি শাখায় এর কার্যক্রম চলে। শিক্ষার্থী প্রায় ৩৭ হাজার। শিক্ষক আছেন আট শর বেশি। আর কর্মচারী আছেন পৌনে দুই শর মতো।
আরও বেশ কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের একাধিক শাখা ক্যাম্পাস রয়েছে। এর মধ্যে কিছু কিছু প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে একেবারেই বেসরকারি ব্যবস্থাপনায়।
অভিযোগ আছে ‘সুনামকে’ কাজে লাগিয়েই মূলত শাখা ক্যাম্পাস চালু করা হয়। কিন্তু কলেবর বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে এসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার মান নিয়ে যেমন প্রশ্ন বাড়ছে, তেমনি নানা অভিযোগও উঠছে। এমন অবস্থায় শাখা ক্যাম্পাসের সুযোগ বন্ধের উদ্যোগ নিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।
জানতে চাইলে ঢাকা মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক তাসলিমা বেগম প্রথম আলোকে বলেন, শাখা ক্যাম্পাসকে স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান করার উদ্যোগটি ভালো। কারণ বাস্তবতা হলো, একই পরিচালনা কমিটি ও একই প্রতিষ্ঠানপ্রধানের পক্ষে এতগুলো ক্যাম্পাস ভালোভাবে পরিচালনা করা সম্ভব নয়। তবে আরেকটি বিষয় যুক্ত করা দরকার। সেটি হলো, শিক্ষার্থীরা যে যে এলাকায় বসবাস করবে, সেই এলাকার (ক্যাচমেন্ট এরিয়া) শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়ার ব্যবস্থা করতে হবে। এ জন্য সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকেই মানসম্মত করতে হবে।