রমজানের ১৯তম দিনে ভোরে কুফা মসজিদে ফজরের নামাজের সময় মুসলমানদের চতুর্থ খলিফা হযরত আলী ইবনে আবি তালিবের মাথায় বিষমাখা তরবারি দিয়ে আঘাত করেন আব্দুল রহমান ইবনে মুলজুম। হযরত আলী ইসলামের নবী মুহাম্মদের চাচাতো ভাই ছিলেন।
মারাত্মক এই আঘাত পাওয়ার ঠিক দুই দিন পর ২১তম রমজানের দিন হযরত আলী মারা যান।
হযরত আলীর খেলাফতকালে (ইসলামী শাসন ব্যবস্থা) নানা ঘটনা ঘটেছে, ইসলামিক বিশ্বে যেগুলোর সুদূরপ্রসারী প্রভাব রয়েছে।
তার খেলাফতকালের একটা গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত ছিল ইসলামী রাষ্ট্রের রাজধানী মদিনা থেকে ইরাকের কুফা শহরে স্থানান্তর করা।
যার কারণ এবং পরিণতি নিয়ে আজও বিতর্ক অব্যাহত।
কুফা কোথায় অবস্থিত ?
ইরাকের রাজধানী বাগদাদের ১৭০ কিলোমিটার দক্ষিণে ইউফ্রেটিস নদীর তীরে কুফা শহরটি অবস্থিত।
প্রাচীনকাল থেকেই এই শহরের সমৃদ্ধ ইতিহাস থাকলেও যখন এই অঞ্চলে বিজয়ী মুসলমানরা আসতে শুরু করে তখন এর গুরুত্ব বেড়ে যায়।
বাগদাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আবদ আল রাজ্জাকের মতে, মুসলমানদের দ্বিতীয় খলিফা হযরত উমর ইবনুল খাত্তাবের শাসনামলে সামরিক এবং প্রশাসনিক কারণে সাদ বিন আবি ওয়াক্কাস কুফা প্রতিষ্ঠা করেন। তার পর থেকেই বিপুল সংখ্যক মুসলিম এখানে বসতি স্থাপন করেন।
হযরত উমরের শাসনামলে কুফা শহরে বসবাসকারী লোকদের অনুদান দেওয়ার রীতি শুরু হয়।
এবং ২৪ হিজরি সালের মধ্যে এ শহরের জনসংখ্যা দেড় লাখে পৌঁছায়। মানুষ এখানে এসে থাকতে শুরু করে।
কুফা শহরকে রাজধানী করার কারণ কী ছিল?
আনুষ্ঠানিকভাবে ইসলামি রাষ্ট্রের প্রথম শহর হিসেবে মদিনা বিশেষ গুরুত্ব বহন করে।
এখানে অবস্থিত ‘মসজিদে নববী’ বা নবীর মসজিদ সমগ্র মুসলিম বিশ্বের জন্য এখনও দ্বিতীয় পবিত্র স্থান।
নবীর জীবদ্দশায় মদিনা তার সদর দফতর ছিলো।
তবে, মদিনার পরিবর্তে যখন কুফাকে রাজধানী করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল, সে সময়ের নানা ঘটনাবলী লক্ষ্য করলে বিভিন্ন কারণ সামনে আসে।
যাই হোক, এরপর মদিনা আর খেলাফতের (ইসলামী শাসন ব্যবস্থা) কেন্দ্রে ফিরে আসতে পারেনি।
এমন কী, হযরত আলীর শাসনকাল শুরু হওয়ার আগেও ইসলামি বিশ্ব দ্বিধাবিভক্ত ছিলো।
৩৬ হিজরিতে জামালের যুদ্ধ বা উষ্ট্রের যুদ্ধের পরে ইসলামের চতুর্থ খলিফা রাজধানী হেজাজ থেকে ইরাকে স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।
ইতিহাসবিদদের মতে, মক্কা ও মদিনার পবিত্রতা রক্ষা করতে চাওয়াই ছিল হযরত আলীর এই সিদ্ধান্তের পেছনে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কারণ।
এবং যেহেতু কুফায় তার বিপুল সংখ্যক সমর্থক ছিল তাই তিনি এই শহরকে রাজধানী করতে আগ্রহ দেখিয়েছিলেন।
ইসলামিক স্কলার সৈয়দ ইরতাজা আব্বাস নাকভী কুফার ইতিহাস নিয়ে ‘তারিখ-ই-কুফা’ নামে একটি বই লিখেছেন।
এই বইয়ে কেন হযরত আলী মদিনার পরিবর্তে কুফাকে নিজের রাজধানী হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন, তার কারণ তুলে ধরেছেন তিনি।
তিনি লিখেছেন, কুফার জনগণ প্রথম মালিক ইশতারের নির্দেশনায় আমিরুল মুমিনিনের (মুসলিম খলিফাদের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত একটি সম্মানসূচক উপাধি, অর্থ বিশ্বাসীদের নেতা) প্রতি আনুগত্যের অঙ্গীকার করেছিল।
আমিরুল মুমিনিন ৩৬ হিজরিতে মদিনা নিবাসী এক হাজার যোদ্ধা এবং ১২ হাজার কুফা যোদ্ধা নিয়ে কুফার উদ্দেশে রওনা দেন।
জামালের যুদ্ধে (উষ্ট্রের যুদ্ধ) বেশির ভাগ কুফাবাসী জনগণ আমিরুল মুমিনিনকে সমর্থন করেছিলো।
এবং এরপরই হযরত আলী এই শহরকে নিজের রাজধানী হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন।
রাজনৈতিক ও সামরিক কারণ
সে সময় ইসলামিক বিশ্বের প্রধান কেন্দ্রগুলোর মধ্যে ছিল সিরিয়ার দামেস্ক, হেজাজের মক্কা ও মদিনা এবং ইরাকের বসরা ও কুফা।
এটি এমন একটা সময় ছিল যখন একদিকে মুয়াবিয়া বিন আবি সুফিয়ান দামেস্কের গভর্নর ছিলেন।
তিনি সুহাইল বিন হানিফের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে অস্বীকার করেছিলেন। হযরত আলীর খেলাফত গ্রহণের পর সিরিয়ার জন্য সুহাইলকে গভর্নর করা হয়।
অন্য দিকে, মক্কাতে হযরত আলীও বিরোধীদের প্রতিরোধের মুখে পড়েছিলেন।
অধ্যাপক সৈয়দ আবদুল কাদির এবং মুহাম্মদ সুজা উদ্দিনের ‘ইসলামের ইতিহাস’ বই অনুসারে, এই সিদ্ধান্তের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কারণ ছিল হযরত আলী মদিনাকে আরও গৃহযুদ্ধ থেকে বাঁচাতে চেয়েছিলেন।
এই বইটি অনুযায়ী, হযরত আলী চেয়েছিলেন মদিনা যেন স্থানীয় রাজনৈতিক সংঘাতের কেন্দ্রে পরিণত না হয়।
এবং তিনি ইসলামের নবীর স্মৃতিবিজড়িত এই শহরটিকে ভবিষ্যতের গৃহযুদ্ধ এবং সম্ভাব্য যুদ্ধ থেকে রক্ষা করতে চেয়েছিলেন।
কুইল কারমাইকেলের বই ‘দ্য শেপিং অফ আরবস’ অনুসারে, যখন ইসলাম অধিকৃত অঞ্চলের সীমানা বাড়তে থাকে, তখন এই ধর্মটি রোমান ও গ্রীক সভ্যতার পাশাপাশি ইরানী চিন্তাধারার মুখোমুখি হয়।
এবং সেই সব নতুন ঐতিহ্য ও মূল্যবোধ ইসলামী চিন্তাধারায় মিশে যেতে শুরু করে।
কিন্তু, হযরত আলী ইসলামের শাসন কেন্দ্র মদিনা থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন এবং অন্তত হেজাজ (সৌদি আরবের পশ্চিমাঞ্চল) পর্যন্ত ইসলামের জীবন ব্যবস্থাকে রক্ষা করেছিলেন।
এবং ইসলাম এসব শহরে দীর্ঘকাল পর্যন্ত টিঁকে ছিলো, যেমনটা ইসলামের নবীর সময়ে ছিল।
অর্থনৈতিকভাবে, মদিনা ও হেজাজ অঞ্চলের কিন্তু ইরাক বা সিরিয়ার সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার মতো ক্ষমতা ছিল না।
কারণ মদিনার অবস্থান ছিল মরু অঞ্চলে যেখানে চাষাবাদ, কৃষি, পরিবহন ও সক্রিয় ব্যবসা-বাণিজ্যের অভাব ছিল। অন্য দিকে ওই অঞ্চলের আয়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উৎস ছিল ইরাক।
ইসলামী রাষ্ট্রের সম্প্রসারণের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হল, কুফার অবস্থান ছিল ভৌগোলিকভাবে তৎকালীন ইসলামী বিশ্বের প্রায় কেন্দ্রস্থলে।
যেখান থেকে ইরান, হেজাজ, সিরিয়া এবং মিশরকে নজরদারি করা যেত। আর দেশ পরিচালনার জন্যও এটি ভালো অবস্থান ছিল।
আরেকটি কারণ হলো, জনবলের দিক দিয়ে মদিনার সিরিয়ার সঙ্গে সর্বাত্মক যুদ্ধে যাবার মতো সামর্থ্য ছিল না।
অন্যদিকে কুফা নিজেই একটি ঘনবসতিপূর্ণ নগরী এবং বিশাল জনসংখ্যার শহরগুলির কাছাকাছি অবস্থিত ছিল। ফলে হযরত আলী বিভিন্ন ধরনের আগ্রাসন মোকাবেলায় সক্ষম ছিলেন।
‘ক্যাপিটাল সিটিজ অব ইসলাম’ বইয়ে বলা হয়েছে, হযরত উমরের শাসনামলে বিজয়ের কারণে মিশর ও পারস্যের মতো উর্বর স্থান থেকে সম্পদ পাওয়া যাচ্ছিল।
যার প্রভাব মক্কা ও মদিনায় দেখা যেতে শুরু করেছিল।
“আবহাওয়া, পানি এবং বাগানের প্রাচুর্যের কারণে সরকারি কর্মকর্তারা ক্রীতদাসদের নিয়ে মদিনায় যেতেন, সঙ্গে থাকত সঙ্গীতশিল্পী ও নৃত্যশিল্পীরা, মদিনায় এর আগে কখনও এমন পরিবেশ দেখা যায়নি”, জানাচ্ছে ওই বইটি।
মুসলিম ঐতিহাসিকদের মতে, এ অবস্থায় মদিনার অধিবাসীরা আরাম, আয়েশ ও ভোগবিলাসে ডুবে ছিল।
অন্যদিকে কুফা ছিল সেই শহর যেখানে মদিনা থেকে স্থানান্তরিত ও বসতি স্থাপনকারী সাহাবীদের সংখ্যা ইসলামী বিশ্বের অন্য সব শহরের চেয়ে বহুগুণ বেশি ছিল।
এবং হযরত আলী মদিনা ও মক্কার চেয়ে এখান থেকেই বেশি সমর্থন পেয়েছিলেন।
কুফা পাঁচ বছর ইসলামী রাষ্ট্রের রাজধানী ছিল।
৪০ হিজরিতে যখন মুয়াবিয়া বিন আবু সুফিয়ান মক্কা ও মদিনা দখল করে ইয়েমেনের দিকে অগ্রসর হতে শুরু করেন, তখন ইয়েমেনের গভর্নর উবায়দুল্লাহ বিন আব্বাস যুদ্ধ না করে কুফায় ফিরে যান।
হযরত আলী যখন এই বিদ্রোহের খবর পেয়েছিলেন তিনিও যুদ্ধের জন্য একটি বাহিনী পাঠাতে চেয়েছিলেন।
কিন্তু যখন ১৯তম রমজানের দিন তিনি তার পছন্দের রাজধানীর মসজিদে মারাত্মকভাবে আঘাত প্রাপ্ত হন এবং মারা যান, তখনও এই বাহিনী রওনা দেয়নি।
এরপর কুফা ইসলামিক সরকারের রাজধানী হওয়ার গৌরব হারায় এবং সরকারের কেন্দ্র সিরিয়ায় স্থানান্তরিত হয়।