শ্রীমঙ্গলে কালের সাক্ষী প্রাচীন স্থাপত্যশৈলীর বরুণা বড় মসজিদ

এহসান বিন মুজাহির -শ্রীমঙ্গল।

মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলে ঐতিহাসিক স্থাপত্যে নির্মিত চারশো বছরের পুরনো বরুণা বড় জামে মসজিদটি কালের সাক্ষী হিসেবে দাঁড়িয়েছে আছে। ঐতিহাসিক এই মসজিদটির অবস্থান মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গল উপজেলার কালাপুর ইউনিয়নের হাইল হাওরের পূর্ব পাড়ে বরুণা গ্রামে।

সোমবার (২২ মে) বেলা ১টায় সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, প্রায় ষাট শতাংশ জায়গায় নির্মিত মসজিদটি লম্বায় ৪৪ হাত, পাশে ১১ হাত সঙ্গে ১১ হাত একটি বারান্দা সংযুক্ত রয়েছে। চারপাশের দেয়ালগুলো সাড়ে তিন হাত। মসজিদের মেহরাবটি পুরোটাই দেয়ালের ভেতরে পড়েছে। মসজিদের উপরে তিনটি দৃষ্টিনন্দন গম্বুজ রয়েছে। প্রত্যেক গম্বুজের ভেতরে গোল অংশে রয়েছে দৃষ্টিনন্দন কারুকাজ। গম্বুজের উপরের অংশ বেশ বড়, যা এখন সবুজ রং করে রাখা হয়েছে। গম্বুজ ছাড়াও এর বিভিন্ন দিকের নান্দনিক কারুকাজ দর্শনার্থীদের মন কাড়ে। মসজিদের ভেতরে পবিত্র কুরআন শরিফ, মোমবাতি ও বই রাখার জন্য কয়েকটি খোপও রয়েছে। মসজিদের চার কোণায় বড় ৪টি ও বারান্দায় ৮টি পিলার রয়েছে। মসজিদটিতে প্রবেশের জন্য তিনটি দরজা, উভয় পাশে দুটি জানালা রয়েছে। এখানে প্রায় সাতশো মুসল্লি একসাথে নামাজ আদায় করতে পারেন।

মসজিদ কমিটি সুত্রে জানায়, প্রায় এক যুগ পূর্বে মসজিদের সামনের প্রাচীর এবং প্রাচীরের উপরে থাকা মিনারটি ভেঙে পড়ে। ২০১৬ সালে প্রবেশপথে মসজিদ কর্তৃপক্ষের তত্ত্বাবধানে প্রায় পঞ্চাশ ফুট লম্বা নয়নাভিরাম মিনার নির্মাণ করা হয়। তাছাড়া সামনের প্রাচীর সরিয়ে সেখানে মসজিদ থেকে একই বাউন্ডারিতে স্থাপিত হয়েছে বিশাল ঈদগাহ মাঠ। যেখানে প্রায় দুই থেকে আড়াই হাজার মুসল্লি একসাথে ঈদের নামাজ আদায় করতে পারেন। মসজিদের পেছনে রয়েছে শান বাঁধানো ঘাটসহ একটি পুকুর।

জোহরের নামাজ পড়ে বের হওয়া মুসল্লি জান্নাত আলী-কে মসজিদটিতে নামাজ আদায় করতে কেমন লাগে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন মসজিদের ভেতর সব সময় ঠান্ডা থাকে। ভেতরে কোনো এসি না থাকলেও এমন মনে হয় যেনো এসির নিচে দাঁড়িয়ে নামাজ পড়ছি।

এলাকার জান্নাত আলী বলেন, এই মসজিদটির স্থাপত্য সম্পর্কিত সঠিক কোনো সঠিক তথ্য আজ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। আমাদের বাপ-দাদার দাদার আমলেও মসজিদটি ছিল। এখন মসজিদটি সংস্কার জরুরি। সবার সহযোগিতায় পেলে মসজিদের মক্তব ও বারান্দা সংস্কার করা সম্ভব হবে।

বরুণা চাইল্ড কেয়ার এডুকেশন সেন্টার এর প্রধান শিক্ষক আলী আহমদ বলেন, শ্রীমঙ্গ উপজেলার সুনাম দেশ বিদেশে ছড়িয়ে পড়েছে। কয়েকশ বছরের ঐতিহ্যবাহী বরুণা বড় মসজিদটি সংস্কার করলে নতুন প্রজন্ম ও দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা ভ্রমণপিপপাসুরা এটি দেখতে পারবেনন এবং এর ঐতিহ্য সম্পর্কে জানতে পারবেন। এছাড়া পুরনো ঐতিহ্যের ইতিহাস সমৃদ্ধ তথ্যটি যদি সকলের দৃষ্টিগোচরের জন্য সামনে রাখা হতো তাহলে ইতিহাসপিপাসুরা সহজে ইতিহাস জানতে পারবেন।

বরুণা এলাকার বাসিন্দা মুফতি ফাহিম আল হাসান বলেন, প্রাচীন স্থাপত্যশৈলীর মসজিদগুলো শতাব্দীর পর শতাব্দী ইসলামি ঐতিহ্য বহন করে আসছে। এমনই একটি প্রাচীন মসজিদ হলো বরুণা বড় মসজিদ। এটি দেখতে প্রায়ই দূর দুরান্ত থেকে দর্শনার্থীরা ছুটে আসেন। সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ এর কাঠামো অক্ষুন্ন রেখে মসজিদটি সংস্কার সাধন করলে ঐতিহ্যটি সংরক্ষিত থাকতো।

মসজিদ কমিটির সদস্য, এলাকার শতবর্ষী মুরব্বি হাজী আব্রু মিয়া বলেন, মসজিদটি কত বছর আগে এর কোনো সঠিক রেকর্ড নেই। আমি শুনেছি আমার দাদার দাদারাও এই মসজিদে নামাজ পড়েছেন। মসজিদের সাথে পরবর্তীতে বারান্দা যুক্ত করা হয়েছে, বারান্দা লাগানোর বয়সই শত বছর ছুই ছুই করছে। বারান্দার কাঠে খোদাই করা লেখা রয়েছে ১৯২৯ ইংরেজি এবং ১৩৩৬ বাংলা। তিনি বলেন বারান্দার বয়স শত বছর হয়ে যাওয়ার টিনের চাল ও কাঠ নষ্ট হয়ে গেছে। পুরনো মসজিদটির বারান্দা ঢালাই করার পরিকল্পনা নিয়েছে মসজিদ কমিটি। আমরা সরকারের সহযোগিতা চাই।

 

এলাকার তরুণ ব্যবসায়ী আব্দুস সামাদ বলেন, বরুণা বড় মসজিদটি আমাদের এলাকার গর্ব। মসজিদটি সৌন্দর্যবর্ধনে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।

 

মসজিদ কমিটির বর্তমান সভাপতি হামজা মিয়ার (৬০) কাছে মসজিদের নির্মাণের তারিখ জানতে চাইলে তিনি বলেন, শ্রীমঙ্গল উপজেলার সবচেয়ে প্রাচীন স্থাপত্য বড় মসজিদ বরুণা জামে মসজিদ। কত আগের মসজিদ এটি, কারা নির্মাণ করেছেন এর কোনো সঠিত তথ্যই নেই কারো কাছে। আমাদের বাপ, দাদার দাদার আমল থেকেই এ মসজিদে নামাজ পড়ে আসছেন মুসল্লিরা। নির্মাণ স্থাপত্যশৈলী দেখলে বোঝা যায় এটি প্রাচীনকালের। যখন মসজিদটি প্রতিষ্ঠিত হয় তখন এ অঞ্চলে এটিই ছিল সবচেয়ে বড় মসজিদ। কারণ মসজিদটি এতই প্রাচীন যে এর ইতিহাসও কেউ মনে রাখতে পারেননি। তিনি বলেন এরশাদ সরকারের আমলে একজন প্রকৌশলী পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে জানতে পারেন, আনুমানিক চারশো বছর পূর্বে মসজিদটি স্থাপিত হয়। মসজিদে প্রবেশের প্রধান ফটকে ১৫৯৩ ঈসায়ি এবং ১০০০ বাংলা তারিখ লেখা রয়েছে। এর দ্বারা প্রতিয়মান হয় মসজিদটি ৪৩০ বছর আগে নির্মিত হয়েছে।

এলাকার মুরব্বি মোঃ মালদার মিয়া বলেন, সংস্কারের অভাবে নষ্ট হচ্ছে শ্রীমঙ্গল বহু বছরের পুরনো ঐতিহাসিক বরুণা বড় জামে মসজিদ। এই মসজিদটিকে সংস্কার-সৌন্দর্যবর্ধন ও সংরক্ষণের দাবি জানিয়েছেন তিনি। মুরব্বি মালদার আরো বলেন, এই স্থাপত্যের অবকাঠামো নির্মাণে পোড়ামাটি, চুন ও ইট ব্যবহার করা হয়েছে। মসজিদটি নির্মাণে কোনো রড ব্যবহার করা হয়নি।

ঐতিহ্যবাহী মসজিদটির বর্তমান খতিব মাওলানা কে এম মোজাহিদ আলী বলেন, শ্রীমঙ্গল উপজেলার সবচেয়ে প্রাচীন স্থাপত্য বড় মসজিদ বরুণা জামে মসজিদ। এটি মুঘল আমলেরও বহু আগে নির্মিত হয়। তবে সুনির্দিষ্ট কোনো তারিখ কারো কাছে সংরক্ষণে নেই। তিনি বলেন

মসজিদের বারান্দায় কাঠের উপর টিনের ছাউনি যা মূল মসজিদের সঙ্গে পরবর্তীতে সংযুক্ত করা হয়েছে। শুধু এই বারান্দার বয়ই ৯৪ বছর। মসজিদটি বহু পুরনো হওয়ায় প্রতিনিয়তই পর্যটকর দেখতে আসেন। যদি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এর অবকাঠামো ঠিক রেখে সংস্কার করেন তাহলে মসজিদের সৌন্দর্য আরো বহুগুণে বৃদ্ধি পেতো। ইতিহাস-ঐতিহ্য হিসেবে এ মসজিদের অবকাঠামো ও সৌন্দর্যবর্ধন করতে তিনি সরকার ও সংশ্লিষ্টদের এগিয়ে আসার অনুরোধ করেন।

এবিষয়ে জানতে চাইলে শ্রীমঙ্গল উপজেলার কালাপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল মতলিব বলেন, বরুণার এলাকার ঐতিহ্যবাহী এই মসজিদটি আমাদের গর্ব। এর নির্মাণ স্থাপত্য নির্ধারণ করে ইউনেস্কোতে বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে সংরক্ষণের উদ্যোগ গ্রহণে সরকার দৃষ্টি আকর্ষণ করবো।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে শ্রীমঙ্গল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আলী রাজিব মাহমুদ মিঠুন বলেন, মসজিদটি সংস্কারের জন্য সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগকে জানানো হবে।