ডেস্ক রিপোর্টঃঃ
ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে সিলেটের ভোলাগঞ্জ পাথর কোয়ারির বাংকার এলাকা। প্রায় পাঁচ মাস ধরে অবাধে চলছে পাথর লুট। এ সময়ে শুধুমাত্র বাংকার এলাকা থেকে শত কোটি টাকার পাথর লুট করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা।
সব মিলিয়ে গত পাঁচ মাসে প্রায় এ কোয়ারি থেকে ৪শ’ কোটি টাকার পাথর লুট হয়েছে। লুটপাটের ফলে পাথর কোয়ারির মাটির স্তর পরিবর্তন হওয়ায় নিচ থেকে পাথর তুলতে গিয়ে মারা যাচ্ছে শ্রমিক।
গতকাল দেয়াল ধসে লিটন মিয়া নামে এক শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে। পাথরখেকোরা প্রথমে লাশ লুকিয়ে ফেলার চেষ্টা করলেও পরে পুলিশের হস্তক্ষেপে উদ্ধার হয়েছে।
৫ই আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের দিন থেকে সিলেটের ভোলাগঞ্জ কোয়ারি থেকে পাথর লুটপাট শুরু হয়। প্রথম তিনদিনেই দেশের অন্যতম দৃষ্টিনন্দন পর্যটন স্পট সাদাপাথর থেকে প্রায় ১২৫ কোটি টাকার পাথর লুট করা হয়। স্থানীয় পাথরখেকোরা সংঘবদ্ধ হয়ে শ্রমিক নিয়োগ করে এই পাথর লুটপাট চালায়। পরবর্তীতে উপজেলা প্রশাসনের তদন্তে পাথর লুটের ঘটনার সত্যতা মিলেছে। উপজেলা প্রশাসন ক্ষতিপূরণ হিসেবে ১২৫ কোটি টাকা নির্ধারণ করে। এরপর থেকে অবাধে লুট করা হচ্ছে ভোলাগঞ্জের পাথর। স্থানীয় বিএনপি নেতা বাহার ও রেজন এই লুটপাটের নেতৃত্ব দিচ্ছে।
সিন্ডিকেট সদস্যদের দিয়ে ভয়ের পরিবেশ সৃষ্টি করে পাথর লুটপাট করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা। ভোলাগঞ্জ কোয়ারির গুরুত্বপূর্ণ স্থান হচ্ছে রেলওয়ের বাংকার এলাকা। এই বাংকারের ভেতর ও বাইরে রয়েছে অফুরন্ত পাথর। এর বাইরে বাংকারের ভেতরে গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ রয়েছে। বাংকারের নিরাপত্তায় সব সময় নিয়োজিত থাকে রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা। ৫ই আগস্টের দিন পাথরখেকো সিন্ডিকেটরা রেলওয়ের ওই স্থাপনা ও নিরাপত্তা বাহিনীর আবাসস্থলে হামলা চালিয়ে ব্যাপক ভাঙচুর করে।
এরপর থেকে দিনের বেলা দায়িত্ব পালন করলেও রাতে বাংকার এলাকা ছেড়ে এসে স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদে বসবাস করেন তারা। ফলে রাত পুরোপুরি অক্ষতই থাকে। এই সুযোগে বাংকার এলাকায় প্রতিদিন ৪ থেকে ৫শ’ নৌকা গিয়ে পাথর লুট করে নিয়ে আসে। স্থানীয়রা জানান, রেলওয়ের নিরাপত্তা বাহিনী, পুলিশ ও বিজিবি’র সদস্যরা প্রতিটি নৌকা থেকে ১ হাজার করে টাকা নিয়ে পাথর তুলতে সহযোগিতা করছে।
গত পাঁচ মাসের লুটপাটের কারণে বাংকার এলাকার মাটির উপরের অংশে বালু ও পাথর অবশিষ্ট নেই। গত ১৫ দিন ধরে যন্ত্রদানব বোমা মেশিন বসিয়ে পাথর লুটপাট করা হচ্ছে। ফলে বাংকার ও আশপাশ এলাকায় এখন বড় বড় গর্তে পরিণত হয়েছে। গর্তের তলদেশ থেকেও উত্তোলন করা হচ্ছে পাথর। ভোলাগঞ্জ কোয়ারিতে প্রায় এক যুগ আগে একইভাবে পাথর লুটের মহোৎসব চলছিল। ওই সময়ও ঝুকিপূর্ণ হয়ে উঠেছিল কোয়ারি।
বড় বড় গর্তে পাথর তুলতে গিয়ে মাটিচাপায় ৫০ জনের মতো শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে। শ্রমিক মৃত্যুর ঘটনার কারণে পরবর্তীতে সরকার কোয়ারি এলাকা লিজ না দিয়ে বালু ও পাথর উত্তোলন বন্ধ করে দেয়। তখন বেলার পক্ষ থেকে উচ্চ আদালতে রিট করা হয়েছিল। পাঁচ মাসের অবাধ লুটপাটে এখন ঝুকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে বাংকার এলাকা। শ্রমিকরা জানান, যন্ত্রদানব বোমা মেশিন দিয়ে রাতে বাংকার ও আশপাশ এলাকা থেকে পাথর উত্তোলন চলছে।
গত রোববার রাতে বাংকারের মসজিদের নিচ এলাকায় তেমনিভাবে বোমা মেশিন লাগিয়ে পাথর উত্তোলন করা হচ্ছিল। এ সময় গর্তের নিচে কয়েকজন শ্রমিক কাজ করছিলেন। ভোররাতে হঠাৎ করে মসজিদের দেয়ালের অংশ ধসে পড়ে নিচে থাকা শ্রমিকদের ওপর। এতে ঘটনাস্থলেই মারা যান স্থানীয় বাগাড় পাড় গ্রামের বাসিন্দা লিটন মিয়া। আহত হন কয়েকজন। দুর্ঘটনার পর লাশ গুম করতে পাথরখেকো সিন্ডিকেটরা নানা তৎপরতা চালায়।
তবে পুলিশের কঠোর অবস্থানের কারণে তারা নিহত শ্রমিক লিটনের লাশ পুলিশের কাছে দিয়েছে। আহতদের অজ্ঞাত স্থানে রেখে তারা চিকিৎসা দিচ্ছে। গতকালের ঘটনার পর রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনীর ভোলাগঞ্জ ইনচার্জ মো. জসিম উদ্দিন মানবজমিনকে জানান, আমরা কী করবো। আমাদের থাকার ঘর সহ জিনিসপত্র ভাঙচুর ও লুটপাট করা হয়েছে। সবাই ইউনিয়ন অফিসে বসবাস করেন। রাতে ওই এলাকায় নজরদারি করা সম্ভব হয় না।
এই সুযোগে চিহ্নিত পাথরখেকোরা বাংকার এলাকায় লুটপাট চালাচ্ছে। তিনি বলেন, পাথর উত্তোলনের কারণে বাংকার এলাকার পরিবেশ ঝুকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এখনই না থামাতে পারলে শ্রমিক মৃত্যুর মিছিল থামানো সম্ভব হবে না। একইসঙ্গে সরকারি সম্পদও তারা লুট করে নিয়ে যাচ্ছে।
কোম্পানিগঞ্জ থানার ওসি উজায়ের আল মাহমুদ আদনাদ জানান, কেউ আহত হয়েছেন কি না- জানি না। তবে পুলিশ একজনের লাশ উদ্ধার করেছে। লিটন মিয়া নামে ওই শ্রমিকের মরদেহ ওসমানী হাসপাতালে রয়েছে। ঘটনার খবর পেয়ে কোম্পানিগঞ্জ থানার ইউএনও সহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা গতকাল দুপুরে বাংকার এলাকা পরিদর্শন করেছেন।
ওই এলাকার নিরাপত্তা জোরদার করতে প্রশাসন কাজ শুরু করবে বলে স্থানীয়দের জানিয়ে এসেছেন উপজেলা কর্মকর্তারা। স্থানীয় কালিবাড়ি, কালাইরাগ, দয়ারবাজার সহ কয়েকটি এলাকার বাসিন্দারাও জানান, বাংকার এলাকায় শ্রমিক মৃত্যু শুরু হয়েছে। এ ব্যাপারে প্রশাসনের তরফ থেকে দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে সামনে পরিস্থিতি ভয়ংকর হতে পারে।