নিজস্ব প্রতিবেদকঃ
মৌলভীবাজারের লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের একটি মায়া হরিণের জবাই করা দেহ ঢাকাগামী কালনি ট্রেন থেকে গত বুধবার উদ্ধার করে শ্রীমঙ্গল রেলওয়ে পুলিশ।
হরিণটির গায়ে আঘাতের চিহ্ন রয়েছে এবং হরিণটি জবাই করা হয়েছে বলে দাবি বনবিভাগ ও রেলওয়ে পুলিশের। তারা আরও দাবি করেন, এটি মায়া হরিণ এবং একমাত্র এ এলাকার লাউয়াছড়া বনেই এই হরিণ রয়েছে।
হরিণটি কীভাবে চলন্ত ট্রেনে আসল তা নিয়ে নানামুখী প্রশ্ন দেখা দেয়।
এ নিয়ে গত দুই দিনের অনুসন্ধানে জানা যায়, কালনি ট্রেনের চালক লাউয়াছড়া বনের ভেতর ট্রেন থামিয়ে হরিণটি জবাই করেন এবং সেই সময় কোনো অনুমতি ছাড়া তিনি ৬ মিনিট হরিণ জবাই করার জন্য ট্রেনটি লাউয়াছড়া বনের ভেতর দাঁড় করিয়ে রাখেন। ওই ট্রেনের একাধিক যাত্রী এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
এই ট্রেনের যাত্রী ছিলেন সন্তুশ দাস। তিনি কুলাউড়া থেকে শ্রীমঙ্গলের উদ্দেশে ট্রেনে উঠেন।
তিনি বলেন, ‘লাউয়াছড়ায় আসার কিছুক্ষণ পর আমি ওয়াশরুমে যাই, তো হঠাৎ করে দেখি ট্রেন থেমে গেছে। আমি সাথে সাথে বের হই, তারপরে শুনি যে একটা হরিণের জন্য ট্রেন থেমেছে। কেউ বলছে শিকারীরা হরিণকে ফায়ার করছে, হরিণ দৌড় দিয়ে গাড়ির সামনে পড়ছে, আবার কেউ বলছিল বন বিভাগের লোকজন সাথে ছিল। পরে দেখলাম হরিণ আহত হয়েছে, এর জন্য জবাই করছে। জবাই অবস্থায় নিয়ে আসতে দেখছি। অনেকে ভিডিও করছে। এর পর ট্রেন ছেড়ে দেয়।’
সেদিনের কয়েকটি ছবি এসেছে প্রতিবেদকের হাতে, সেই ছবিতে দেখা যায় দাঁড়িওয়ালা এক ব্যক্তির হাতে জবাই করার অস্ত্র। তবে তিনি নিজেই চালক ছিলেন কি না তা এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি তবে অনেক মাধ্যমে চালক বলে দাবি করা হয়েছে।
এই ট্রেনের আরেক যাত্রী কমলগঞ্জের সুমন আহমদ জানান, ট্রেনটি লাউয়াছড়া বনের ভেতর আসতেই থেমে যায় এবং ৬/৭ মিনিট পর একটি হরিণ নিয়ে এসে আবার ট্রেন ছাড়ে।
সেদিন ট্রেনটি লেইট করে পৌঁছায় স্টেশনে। ভানুগাছ রেলওয়ে স্টেশনের সহকারী স্টেশন মাস্টার তার রেকর্ড বুক থেকে জানান, ভানুগাছ থেকে ৮.২৮ মিনিটে ট্রেনটি ছেড়ে আসে এবং ৮.৫৪ মিনিটে মঙ্গল স্টেশনে পৌঁছায়। সাধারণ সময়ে ২০ মিনিট লাগলেও এদিন লাগে ২৬ মিনিট।
বনবিভাগ সূত্রে জানা যায়, ট্রেন না থামিয়ে কোনোভাবেই হরিণ ট্রেনে তোলার কথা না। এই হরিণের গায়ে আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। ট্রেনের গায়ে লেগে হরিণটি আহত হয় পরে জবাই করে ট্রেনে তোলা হয়।
বনবিভাগের একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘আমাদের শতভাগ ধারণা যে চালক ট্রেন থামিয়েছেন এবং জবাই করে তা ট্রেনে তোলা হয়। কারণ ট্রেন না থামালে তা কোনো ভাবেই ট্রেনে তোলা সম্ভব নয়। এই মায়া হরিণ লাউয়াছড়া বনেই সাধারণত দেখা যায় এবং অতীতেও ট্রেনের ধাক্কায় হরিণ আহত বা মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে।
ময়নাতদন্তে জানা যায়, হরিণটি জবাই করে হত্যা করা হয়েছে যদিও এর গায়ে আরও আঘাত ছিল।
শ্রীমঙ্গল উপজেলা প্রাণী সম্পদ কর্মকর্তা কর্ণ চন্দ্র মল্লিক বলেন, ‘আমরা পোস্ট মর্টেম করে বুঝতে পেরেছি প্রাণীটিকে ধারালো কোনো জিনিস দিয়ে গলা কেটে হত্যা করা হয়েছে।’
বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের সহকারী বন সংরক্ষক (এসিএফ) শ্যামল কুমার মিত্র জানান, ঢাকাগামী কালনি ট্রেন থেকে হরিণের মৃতদেহ উদ্ধার করে শ্রীমঙ্গল রেলওয়ে থানা পুলিশ, পরে তারা আমাদের জানায়। আমার ধারণা চলন্ত রেলের আঘাতে হরিণটি আহত হয় এবং পরে জবাই করা হয়।
তিনি বলেন, ‘আমরা পোস্টমোর্টেম করে জানতে পেরেছি জবাই করার কারণেই তার মৃত্য হয়। গায়ে আঘাতের দাগ থাকলেও তার কারণে মৃত্য হয়নি। জবাই না করলে এই আঘাতে সুস্থ হয়ে যেত।’
শ্রীমঙ্গল রেলওয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা শাফিউল ইসলাম পাটোয়ারী বলেন, ‘আমার ধারণা ট্রেনের আঘাতে আহত হয় এবং পরে তা ট্রেনে তুলা হয়। কীভবে তোলা হয়েছে তা তদন্ত ছাড়া বলা যাবে না।’
কালনির ট্রেনের সেই চালকের সাথে কথা বলার জন্য একাধিক বার শ্রীমঙ্গল রেলওয়ে স্টেশন মাস্টারের সাথে যোগাযোগ করলেও তিনি চালকের মোবাইল নাম্বার দিতে পারেন নি। বিষয়টি নানাভাবে তিনি এড়িয়ে যান।
তবে এ বিষয়ে রেলওয়ে পুলিশের কাছে অভিযোগ করেছে বনবিভাগ। বর্তমানে বিষয়টি তদন্ত করছে রেলওয়ে পুলিশ।
রেলওয়ে পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা শাফিউল ইসলাম পাটোয়ারী জানান, এখানে অনেক প্রশ্ন সামনে আসছে, সঠিক কিছু বলা যাচ্ছে না তদন্ত ছাড়া। তবে হরিণটি লাউয়াছড়ার এবং সেখান থেকেই ট্রেনে উঠানো হয়েছে।